আপনি কি জানেন, আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিদিন কতটা সম্ভাবনাময় কাজ করে? প্রতিদিন আমাদের মস্তিষ্ক অসংখ্য সিদ্ধান্ত নেয়, সমস্যার সমাধান করে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে এবং নতুন কিছু শেখে। প্রতিনিয়ত কাজ করতে করতে একসময় মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করে।
ভালো খবর হলো, কিছু সহজ অভ্যাস গড়ে তুললে আপনি আপনার উপস্থিত বুদ্ধিকে (presence of mind) অনেকাংশে বাড়াতে পারেন। চলুন জেনে নিই এমন ১১টি অভ্যাস যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা এবং উপস্থিত বুদ্ধি বাড়াতে সহায়ক:
মানব মস্তিষ্কে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন আছে। এগুলো একে অপরের সঙ্গে ট্রিলিয়ন সংযোগ গড়ে তোলে। এই সংযোগগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের চিন্তাভাবনা, স্মৃতি ও আচরণ। সৃজনশীল কাজ যেমন—চিত্র আঁকা, গল্প লেখা, সংগীত চর্চা বা নতুন কিছু শেখা—নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ায়, অর্থাৎ মস্তিষ্ক নিজে নিজেই নতুন সংযোগ তৈরি করে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে।
বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, পরিবারকে সময় দেয়া কিংবা নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হওয়া—এসব সামাজিক যোগাযোগে অংশ নিলে মস্তিষ্কে ডোপামিন ও অক্সিটোসিন নামক “হ্যাপি হরমোন” নিঃসৃত হয়, যা আপনার মনোযোগ এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়ায়। সমাজের বিভিন্ন মানসিকতা ও চিন্তা-ধারার মানুষদের বুঝতে শেখা আপনাকে যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
আপনার মস্তিষ্ক যেমন তথ্য গ্রহণ করে, তেমনি এটি সুস্থ থাকতে চায়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিনে ভরপুর খাদ্য যেমন—আখরোট, সামুদ্রিক মাছ, শাকসবজি ও ফল—মস্তিষ্কের কোষগুলোকে সর্বদা সজীব রাখে। গবেষণায় প্রমাণিত, এই উপাদানসমূহ নিউরনের কার্যক্ষমতা রক্ষা করে এবং স্মৃতি শক্তিকে উন্নত করে।
অনেকেই মনে করেন ব্যায়াম কেবল শরীর গঠনের জন্য। কিন্তু আধুনিক গবেষণা বলছে—নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতার ওপরও দারুণ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে হিপোক্যাম্পাস নামে পরিচিত মস্তিষ্কের একটি অংশ, যা স্মৃতি সংরক্ষণ ও শেখার ক্ষমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এই অংশটির আকার ব্যায়ামের ফলে বৃদ্ধি পায়। হাঁটাহাঁটি, দৌড়, সাইক্লিং কিংবা যোগব্যায়ামের মতো ব্যায়াম মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়, নিউরনের মধ্যে সংযোগ গড়ে তোলে এবং নতুন নিউরন তৈরিতে সহায়তা করে। ফলে শুধু শরীর নয়, মস্তিষ্কও হয়ে ওঠে তরতাজা ও কর্মক্ষম।
প্রতিটি নতুন মানসিক চ্যালেঞ্জ, যেমন—অজানা কোনো বিষয় পড়া, জটিল অঙ্কের সমাধান করা বা একদম নতুন কোনো দক্ষতা শেখা—মস্তিষ্কের নিউরনের মধ্যে নতুন সংযোগ সৃষ্টি করে। এই সংযোগগুলোই ধীরে ধীরে আপনার মস্তিষ্কের ‘রোড ম্যাপ’ গঠন করে, যেটি আপনাকে আরও দ্রুত, কার্যকর ও সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে সহায়তা করে। সহজভাবে বললে, আপনি যত বেশি নতুন কিছু শেখেন, আপনার মস্তিষ্ক তত বেশি নমনীয়, চটপটে এবং বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে ওঠে।
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, ধ্যান মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশকে সক্রিয় করে তোলে। এই অংশটি আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া, মনোযোগ ধরে রাখা এবং সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। প্রতিদিন মাত্র ১০ মিনিট মনোযোগ সহকারে ধ্যান করলেও মস্তিষ্কে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। তাই, উপস্থিত বুদ্ধি বাড়াতে নিয়মিত ধ্যান করুন।
ভিডিও লিংক :
আমরা জানি, নতুন ভাষা শেখা যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ায়। এছাড়া এটি মস্তিষ্ককে এক নতুন সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা সঙ্গে পরিচিত করায়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক ব্যক্তিরা সমস্যা সমাধান, মনোযোগ ধরে রাখা এবং তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একভিন্ন ভাষাভাষী ব্যক্তির চেয়ে বেশি দক্ষ। কারণ, তারা প্রতিনিয়ত এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় স্থানান্তর করতে করতে মানসিকভাবে আরও নমনীয় হয়ে ওঠে। তারা একই সময়ে একাধিক বিষয় নিয়েও ভাবতে সক্ষম হন।
এই প্রক্রিয়াটি মস্তিষ্কে নতুন নিউরোনাল সংযোগ তৈরি করে, যা স্মৃতি শক্তি উন্নত করে এবং বয়সজনিত মানসিক অবক্ষয় রোধে সহায়তা করে। তাই মস্তিষ্কের শক্তি বাড়াতে নতুন নতুন ভাষা শিখুন।
নিয়মিত বই পড়া মস্তিষ্কের জন্য এক গভীর ব্যায়াম। প্রতিদিন নিয়ম করে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুললে আমাদের মস্তিষ্কে অসংখ্য নতুন নিউরাল সংযোগ তৈরি হয়।
এই পড়ার অভ্যাস ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ককে এমনভাবে বিস্তৃত করে যে আমরা আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারি । যার ফলে সমস্যার বহুমুখী সমাধান খুঁজে পেতে সক্ষম হই ।
ঘুম হলো মস্তিষ্কের “রিচার্জিং টাইম”। ঘুমের সময় মস্তিষ্ক সারাদিনের তথ্যকে সংরক্ষণ করে, অপ্রয়োজনীয় তথ্য মুছে ফেলে এবং পরের দিনের জন্য প্রস্তুত হয়। ঘুম কম হলে শেখার ও মনে রাখার ক্ষমতা কমে যায়, মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। তাই প্রতিদিন ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
তবে হ্যাঁ, কোনো কারণে যদি ঘুম কম হয়, সেটি নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা ঠিক নয়। তখন মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখা এবং কাজের প্রতি ফোকাস ধরে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয় এমন বেশ কিছু গেম রয়েছে, কারণ এগুলি স্মৃতিশক্তি, সমস্যা সমাধান, মনোযোগ এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার মতো জ্ঞানীয় কার্যকলাপ উন্নত করতে পারে।
সুডোকু, দাবা, ক্রসওয়ার্ড, পাজল ইত্যাদি গেম শুধু বিনোদনের উপায় নয়—এগুলো মস্তিষ্কের নিউরন সংযোগ মজবুত করে, স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা উন্নত করে। দিনে অন্তত ১৫ মিনিট সময় দিন কোনো একটি ব্রেন গেমে। এটি ম্যাজিকের মতো কাজ করবে।
প্রযুক্তির স্মার্ট ব্যবহার আমাদের দিতে পারে জ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডার। কিন্তু এই আশীর্বাদ যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, তখন সেটিই হয়ে উঠতে পারে এক নিঃশব্দ অভিশাপ।
ঘন্টার পর ঘন্টা স্ক্রল করা, লাগাতার ভিডিও দেখা বা অনিয়ন্ত্রিত গেম খেলা ধীরে ধীরে মনোযোগ কমিয়ে দেয়, সৃষ্টি করে একধরনের মানসিক অবসাদ এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলে আমাদের স্মৃতিশক্তির উপর। তখন প্রযুক্তি তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করুন আপনার সম্ভাবনা বিকাশে। ডিজাইন শেখা হোক বা প্রোগ্রামিং, ভাষা শেখা হোক বা লেখালেখি—প্রযুক্তি হতে পারে আপনার সেরা সহযাত্রী, যদি আপনি সেটিকে সঠিকভাবে চালনা করতে পারেন।
প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক আলাদা, কিন্তু কিছু অভ্যাস সবার জন্যই কার্যকর। প্রতিদিনের রুটিনে এই ছোট ছোট পরিবর্তন আনলেই আপনার উপস্থিত বুদ্ধি, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.
Δ
Username or Email Address
Password
Remember Me
Email Address
Log In
Or copy link