Comment

ভূমি বিষয়ক সাধারণ ধারণা

ভূমি ও ভূমির খতিয়ান পরিচিতি

Estimated reading: 1 minute 17 views Contributors

বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা একটি জটিল বিষয়, বিশেষ করে যখন আপনি ভূমি ক্রয়-বিক্রয় বা নামজারি করতে চান। এই টিউটোরিয়ালে আমরা ভূমির পরিচিতি, খতিয়ান, বিভিন্ন ধরনের জরিপ এবং রেকর্ড সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আশা করি, এই গাইডটি আপনাকে ভূমি বিষয়ক জটিলতা দূর করতে সহায়তা করবে।

ভূমির সঠিক পরিচিতি নির্ধারণ

একটি ভূমির সঠিক পরিচিতি নির্ধারণ করতে নিম্নোক্ত তথ্যগুলো জানা জরুরি:

  • জেলা
  • উপজেলা/থানা
  • মৌজার নাম
  • জে.এল. নাম্বার (জুরিসডিকশন লিস্ট নাম্বার)
  • দাগ নাম্বার
  • মোট জমির পরিমাণ

উদাহরণস্বরূপ:

  • জেলা: মেহেরপুর
  • উপজেলা: মেহেরপুর সদর
  • মৌজার নাম: বামন পাড়া
  • জে.এল. নাম্বার: ৫১
  • দাগ নাম্বার: ১৭১
  • মোট জমির পরিমাণ: ০.৬৪ একর (৬৪ শতক)

উপরোক্ত তথ্য থেকে বোঝা যায় যে মেহেরপুর জেলার মেহেরপুর সদর উপজেলার বামন পাড়া মৌজার ৫১ নং জে.এল. অন্তর্ভুক্ত ১৭১ নং দাগে ০.৬৪ একর জমি রয়েছে।

ভূমি/জমির খতিয়ান কী?

খতিয়ান হলো ভূমির মালিকানার নথি যেখানে মালিকের নাম, পিতার নাম, দাগ নাম্বার, জমির পরিমাণ, জমির শ্রেণী ইত্যাদি তথ্য থাকে। এটি ভূমির আইনি পরিচয় নিশ্চিত করে এবং মালিকানা সুনির্দিষ্ট করে।

খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য:

  • একটি খতিয়ানে একটি বা একাধিক দাগ থাকতে পারে।
  • একটি দাগের সম্পূর্ণ অংশ বা আংশিক অংশ বিভিন্ন খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
  • এক বা একাধিক ব্যক্তি একটি খতিয়ানের মালিক হতে পারেন।

বিভিন্ন ধরনের খতিয়ান

বাংলাদেশে সময়ে সময়ে বিভিন্ন ভূমি জরিপ হয়েছে, এবং প্রতিটি জরিপে ভিন্ন ধরনের খতিয়ান তৈরি হয়েছে। প্রধানত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খতিয়ান রয়েছে:

১. সি এস খতিয়ান (Cadastral Survey)

সময়কাল: ১৮৮৮ – ১৯৪০ সাল

১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে ১৮৮৮ সালে কক্সবাজার থেকে শুরু করে ১৯৪০ সালে দিনাজপুরে শেষ হওয়া এই জরিপকে সি এস জরিপ বা ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বলা হয়। এই জরিপের মাধ্যমে ভূমির সঠিক সীমা ও মালিকানা নির্ধারণ করা হয় এবং এটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও নির্ভুল রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত।

বৈশিষ্ট্য:

  • দুই পৃষ্ঠার খতিয়ান।
  • প্রথম পৃষ্ঠায় জমিদারের নাম, দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় রায়ত বা প্রজাদের নাম।
  • সরেজমিনে প্লট টু প্লট জরিপের মাধ্যমে তৈরি।

গুরুত্ব:

  • এটি সবচেয়ে পুরাতন ও নির্ভরযোগ্য রেকর্ড।
  • জমির সুনির্দিষ্ট সীমানা ও মালিকানা নির্ধারণে সহায়ক।

২. এস এ খতিয়ান (State Acquisition Survey)

সময়কাল: ১৯৫৬ – ১৯৬৩ সাল

১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ এবং ভূমির মালিকানা সরাসরি রায়ত বা প্রজাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য যে জরুরি ভিত্তিতে ভূমি জরিপ পরিচালিত হয়েছিল, তাকে এস এ জরিপ বা স্টেট অ্যাকুইজিশন সার্ভে বলা হয়। এই জরিপের মূল উদ্দেশ্য ছিল জমিদারদের মালিকানা বাতিল করে প্রকৃত কৃষক ও ভূমি ব্যবহারকারীদের নাম রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে ভূমির মালিকানার স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে জমিদারি প্রথা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে স্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement) এর মাধ্যমে জমিদাররা ভূমির মালিকানা লাভ করেন, আর সাধারণ কৃষকরা রায়ত বা প্রজা হিসেবে ভূমি চাষাবাদ করতেন। জমিদারদের মাধ্যমে কৃষকদের উপর বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার ও শোষণ চলতে থাকে। পাকিস্তান আমলে এ প্রথা বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

১৯৫০ সালে প্রণীত রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন (State Acquisition and Tenancy Act, 1950) এর মাধ্যমে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বেশ কিছু সময় লাগে। অবশেষে ১৯৫৬-১৯৬৩ সালের মধ্যে এস এ জরিপের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ কার্যক্রম ত্বরান্বিত হয়।

বৈশিষ্ট্য:

  • এক পৃষ্ঠার খতিয়ান (কিছু ক্ষেত্রে দুই পৃষ্ঠারও হতে পারে)।
  • জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পর মালিকানা পরিবর্তন।

গুরুত্ব:

  • জমিদারদের নাম বাদ দিয়ে সরাসরি রায়ত বা প্রজাদের মালিকানা স্বীকৃতি দেয়া হয়।
  • জরুরি ভিত্তিতে রেকর্ড সংশোধন করা হয়।

৩. আর এস খতিয়ান (Revisional Settlement Survey)

সময়কাল: ১৯৬৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে

ভূমির মালিকানা এবং অন্যান্য পরিবর্তনকে সমন্বয় করার জন্য সংশোধনী জরিপ বা আর এস জরিপ করা হয়। এই জরিপের উদ্দেশ্য ছিল পুরনো রেকর্ড সংশোধন করে ভূমির মালিকানা নিয়ে উদ্ভূত জটিলতা সমাধান করা এবং ভূমির সঠিক তথ্য আপডেট রাখা।

বৈশিষ্ট্য:

  • মালিকানার পরিবর্তন ও রেকর্ডের ত্রুটি সংশোধনের জন্য পুনরায় জরিপ।
  • এক পৃষ্ঠার খতিয়ান, তবে কিছু জেলায় দুই পৃষ্ঠারও হতে পারে।

গুরুত্ব:

  • ভূমির বর্তমান অবস্থা ও মালিকানা সঠিকভাবে প্রতিফলিত করা।

৪. নামজারি খতিয়ান

নামজারি হলো ভূমির মালিকানা পরিবর্তনের পর নতুন মালিকের নামে রেকর্ড সংশোধন। বিভিন্ন কারণে নামজারি প্রয়োজন হতে পারে:

  • উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা অর্জন।
  • দলিল মূলে জমি ক্রয়-বিক্রয়।
  • আদালতের রায় বা ডিক্রি।
  • খাস জমি বন্দোবস্ত।
  • উইল বা হেবা মূলে মালিকানা পরিবর্তন।
  • সমবায় সমিতির আওতায় জমির মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে।

নামজারি খতিয়ানে সর্বশেষ প্রকাশিত খতিয়ানের মতো এক পৃষ্ঠার একটি খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নাবলী

প্রশ্ন ১: খতিয়ান এবং পর্চা কি একই জিনিস?

উত্তর: না। খতিয়ান হলো ভূমির মালিকানার নথি, যেখানে মালিকের নাম, দাগ নাম্বার, জমির পরিমাণ ইত্যাদি থাকে। পর্চা হলো ভূমির সীমানা ও বিবরণ সম্বলিত নথি।

প্রশ্ন ২: দাগ নাম্বার কীভাবে জানা যাবে?

উত্তর: আপনার ভূমির দাগ নাম্বার জানতে হলে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়া অনলাইনে ভূমি রেকর্ড সেবা থেকেও দাগ নাম্বার জানা যায়।

প্রশ্ন ৩: নামজারি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

উত্তর: ভূমির মালিকানা পরিবর্তনের পর আইনি স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নামজারি করা জরুরি। এটি ভবিষ্যতে মালিকানা নিয়ে জটিলতা এড়াতে সহায়ক।

প্রশ্ন ৪: খতিয়ান সংশোধন করা যায় কি?

উত্তর: হ্যাঁ, প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি ও আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খতিয়ানে সংশোধন করা যায়।

ভূমি ব্যবস্থাপনা ও নামজারি বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, এই টিউটোরিয়ালটি আপনাকে ভূমির পরিচিতি ও খতিয়ান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিয়েছে। আপনার ভূমি সম্পর্কিত যেকোনো প্রশ্ন থাকলে মন্তব্যের মাধ্যমে জানাতে পারেন।

Leave a Comment

Share this Doc

ভূমি ও ভূমির খতিয়ান পরিচিতি

Or copy link

CONTENTS

Subscribe

×
Cancel